ইডেন কলেজে টানা তিন বছর ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ছিল না। চলতি বছরের মে’তে তামান্না জেসমিন রিভাকে সভাপতি এবং রাজিয়া সুলতানাকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। পদ পেয়েই শুরু হয় তাদের বেপরোয়া জীবন। অনেকটা মগের মুল্লুকে পরিণত করেন দেশের ঐতিহ্যবাহী এই কলেজ হোস্টেলকে। কলেজ এবং হোস্টেল পরিচালনায় প্রশাসন থাকলেও সবকিছু চলতো এই দুই নেত্রীর অঙ্গুলি হেলনে। সিট বাণিজ্য, চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়েছেন তারা। সাম্প্রতিক ঘটনার পর তাদের নিয়ে আরও ভয়াবহ এবং জঘন্য তথ্য বের হয়েছে নানা মাধ্যমে। খোদ নিজ সংগঠনের বিদ্রোহী নেত্রীরাই তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, ইডেনের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি এই দুই নেত্রী। কথিত নেতাদের তুষ্ট করতে তাদের চাহিদা মতো শিক্ষার্থীদের নানা জায়গায় পাঠাতেন এই নেত্রীরা।
এমন তথ্য প্রকাশের পর দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ঘৃণা আর ধিক্কার জানাচ্ছে মানুষ। প্রশ্ন হলো- এই দুই নেত্রী কাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের এমন বেপরোয়া করে তুলেছেন। তাদের কাছ থেকে কারা এমন সুবিধা নিয়েছে যে, তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সাম্প্রতিক নানা ঘটনা, কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত, বিক্ষোভের মুখে হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর এই দুই নেত্রী আবার বীরদর্পে হলে ফিরে এসেছেন। এরপর থেকে এখন আবার পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। আতঙ্ক ভর করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। এখন প্রশ্ন হলো এত কিছুর পরও কেন এই দুই জনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এত অভিযোগ থাকার পরও কেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতারা ওই দুই জনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। একাধিক সূত্রের দাবি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি আরও অনেকে ইডেন নেত্রীদের আশীর্বাদ দিয়ে আসছেন। এ জন্য তারা এতটা বেপরোয়া। তারা কোনো কিছুই পরোয়া করছেন না। অবলীলায় একটি সরকারি কলেজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। ক্ষমতাশালীদের ছায়ায় থাকায় কলেজ প্রশাসনও তাদের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করার সাহস পাচ্ছে না।
মাসখানেক আগে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার একটি অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাতে এই ছাত্রলীগ নেত্রীকে কোনো এক সাধারণ শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, আমি যদি একটা সিট না দিই, তোদের কোনো বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের? প্রায় সমসাময়িক বের হওয়া আরেকটি অডিও রেকর্ডে রিভা অনেকটা দম্ভ করেই বলেন, ইডেন কলেজের প্রেসিডেন্টের উপরে আর কেউ নাই। শুধু কথায় না কাজেও তাই প্রমাণ করেছেন রিভা। হলে কে থাকবে, না থাকবে, আবাসিক শিক্ষার্থীরা মাসিক কিংবা বাৎসরিক কতো টাকা ‘সিটভাড়া’ দিবে, ক্যান্টিনগুলো কীভাবে চলবে কিংবা কতো টাকা চাঁদা দিবে, ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট সেবা কারা দিবে, ইডেনের আশেপাশে ফুটপাথ দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে ব্যবসার অনুমতি- সবই পরিচালিত হতো ছাত্রলীগ নেত্রীদের আঙ্গুলের ইশারায়। প্রশাসনিক কার্যক্রমে কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ছিল একেবারেই সীমিত। হল প্রভোস্ট থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ পর্যন্ত কেউই ছাত্রলীগ নেত্রীদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সাহস করেননি।
পদ পাওয়ার কিছুদিন যেতে না যেতেই একের পর এক নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরোনাম হতে থাকেন রিভা ও রাজিয়া। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করার অপরাধে দুই শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে হেনস্তার অভিযোগ উঠে সভাপতি রিভার বিরুদ্ধে। দিয়েছিলেন হল ছাড়া করার হুমকিও সেই ঘটনায় চারদিক থেকে ক্রমাগত ধেয়ে আসা সমালোচনার মুখে ক্ষমা চেয়েছিলেন রিভা। তবে সেটি যে একেবারেই লোক দেখানো ছিল, তা প্রমাণ করতে বেশি সময় নেননি এ প্রভাবশালী নেত্রী। ক্যাম্পাসে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারিণী যে তিনি নিজেই সেটি প্রমাণ করতে রিভা দু’দিন পরেই নির্যাতনের অডিও ও তথ্য সংবাদ মাধ্যমে দেয়ার অভিযোগে দুই শিক্ষার্থীকে একটি কক্ষে আটকে রেখে টানা ৬ ঘণ্টা নির্যাতন করেন। ওই সময় সে দুই শিক্ষার্থীকে হেনস্তার পাশাপাশি বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকিও দেন। এরপর প্রশাসনের সহায়তায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনার ‘অপরাধে’ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করান।
এর বাইরে সিট বাণিজ্য ফুটপাথ থেকে প্রাপ্ত চাঁদাবাজির টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগ শীর্ষ নেত্রীদের মনোমালিন্যের কথাও প্রকাশ্যে আসে। সমপ্রতি ইডেনে ছাত্রলীগ কমিটির একটি অংশ আন্দোলনে নামলে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে আরও ভয়াবহ সব অভিযোগ বেরিয়ে আসতে থাকে। চাঁদাবাজি, আসন বাণিজ্যের পাশাপাশি রিভা ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের দিয়ে জোর করে অনৈতিক কাজ করানোর অভিযোগ তুলেন বিদ্রোহী নেত্রীরা। মূলত গত ২৪শে সেপ্টেম্বর ইডেন কলেজ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিয়োগ বাণিজ্য ও নানা অপকর্মের বিষয়ে সাংবাদিকদের তথ্য দেয়ার অভিযোগে জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক ছাত্রলীগ নেত্রীকে হেনস্তা ও মারধরের ঘটনার পর থেকেই বিদ্রোহের সূত্রপাত। দুই নেত্রীর নির্দেশে সেদিন রাতে কমিটির সহ-সভাপতি পদমর্যাদার এই নেত্রীকে ঢুকতে দেয়া হয়নি ক্যাম্পাসেও। আর এর বিরুদ্ধে সেদিন রাত থেকে আন্দোলনে নামে ছাত্রলীগের একাংশ। পরদিন ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির বিভিন্ন পদধারী ২৫ নেত্রী একত্রিত হয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।
সেখানে তারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নানা ধরনের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে ক্যাম্পাসে তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। প্রত্যাখ্যান করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিকেও। বিদ্রোহীদের দাবি কমিটিতে থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তিলোত্তমা শিকদার ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশি রিভা ও রাজিয়ার কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা আদায় করে থাকেন। তাদের পক্ষে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব নয়। সেদিন বিকালে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করতে আসলে তাদের সমর্থক ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে সভাপতি রিভাসহ অন্তত ১০ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আহত হন। বিদ্রোহীদের তোপের মুখে এতদিন ধরে ক্যাম্পাসে রাজত্ব করা এই দুই নেত্রী পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়েন। তবে সেদিন গভীর রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয় বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী কমিটিতে থাকা ১২ নেত্রীকে। সেই সঙ্গে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় ইডেন ছাত্রলীগের কমিটি। কিসের ভিত্তিতে এত দ্রুত এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে এসব নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমরা একটা তদন্ত কমিটি করেছিলাম, তারা তাতে আস্থা রাখতে পারছিল না।
তাই আমরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ একটি বডি মিলে এই ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত করেছি। আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ছাত্রলীগের এই শীর্ষ নেতা বিদ্রোহীদের ইঙ্গিত করে সেদিন আরও বলেছিলেন, সব কিছু নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। তারা যে সিট বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির কথা বলেছে, এটার কোনো প্রমাণ তো দিতে পারছে না। কমিটি দেয়ার পর থেকেই একটি অংশ বার বার কমিটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। বহিষ্কারের পরের দিন ২৬শে সেপ্টেম্বর ইডেন কলেজ ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে বিদ্রোহীরা কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই একটি পক্ষের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া অগ্রহণযোগ্য দাবি করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। কার মদতে এত এত অভিযোগ থাকার পরেও রিভা-রাজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলো না সেই প্রশ্নও তুলেন তারা। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা না হলে আমরণ অনশনের হুমকিও দেন তারা। তবে সেদিন ধানমণ্ডিতে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার এক বৈঠকের পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন সদ্য বহিষ্কৃত নেত্রীরা। বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা বিষয়গুলো বড় ভাইদের জানাতে এসেছিলাম। জানিয়ে এখন চলে যাচ্ছি। সমস্যা সমাধানে তারা দায়িত্ব নিয়েছেন।
আমরা কোনো অনশনে নেই। আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনিয়ম থেকে প্রতিকার পেতে আদালতের দ্বারস্থও হয়েছেন বহিষ্কৃত নেত্রীরা। গতকাল চাঁদাবাজি ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি তামান্না জেসমিন ওরফে রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানাসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মারধরের শিকার ও বিদ্রোহী গ্রুপের নেতৃত্বদানকারী সহ-সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস বাদী হয়ে গতকাল বুধবার এ মামলা করেন। ইডেনে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও প্রশাসন বিস্ময়করভাবে পুরোটা সময় জুড়ে ছিল নীরব। দু’পক্ষের মধ্যে সমস্যা নিরসনে কিংবা সংঘর্ষ এড়াতে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। কেন সংঘর্ষ হয়েছে কিংবা সংঘর্ষে কারা জড়িত এই ব্যাপারেও প্রশাসনকে কোনো অবস্থান কিংবা কার্যক্রম চালাতে দেখা যায়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাষ্য ইডেন কলেজের প্রশাসন আছে নামেমাত্র, ছাত্রলীগ নেত্রীদের ইচ্ছের বাইরে তাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। এদিকে ছাত্রলীগে দু’গ্রুপের অন্তকোন্দলে সবচেয়ে বড় ভোগান্তিতে পড়েছেন ক্যাম্পাসের হাজারো সাধারণ শিক্ষার্থী। গণমাধ্যমে প্রচারিত নানা ধরনের ‘রসালো’ সংবাদে সামাজিকভাবে তারা হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইডেন পড়ুয়া এমন এক সাধারণ শিক্ষার্থী মানবজমিনকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী ইডেন কলেজে বর্তমান ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজারের মতো। এর বেশির ভাগেরই রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা শুধু পড়াশোনা করতেই এই কলেজে ভর্তি হয়েছি। মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর অপকর্মের কারণে যেভাবে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে তাতে আমাদের সম্মানহানি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে কলেজ সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা যাচ্ছে। যে কারণে রিভা-রাজিয়ার বিরুদ্ধে মামলা, তদন্তের নির্দেশ রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক মোছা. রাজিয়া সুলতানাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন নির্যাতিত ছাত্রলীগ নেত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোস্তফা রেজা নুরের আদালতে এ মামলা করেন তিনি। মামলার আবেদনের শুনানি শেষে লালবাগ থানাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আগামী ২৪শে অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মামলায় ইডেন ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদক ছাড়াও নুঝাত ফারিয়া রোকসানা, মিস ইসলাম, নূরজাহান, ঋতু আক্তার, আনিকা তাবাসুম স্বর্ণা ও কামরুন নাহার জ্যোতিসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২৫/৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আদালতে বাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন নূর-ই আলম। তাকে সহযোগিতা করেন আইনজীবী আমির আলী, আনোয়ার হোসেন মনির, আবুল কালাম ও মাজেদুর রহমান। পরে নূর-ই আলম মানবজমিনকে বলেন, মামলার আবেদনের শুনানি শেষে আদালত লালবাগ থানাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ২৪শে অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মামলায় বলা হয়, তামান্না জেসমিন রিভা ও রাজিয়া সুলতানার নেতৃত্বে অন্য আসামিরা ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য, অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী জান্নাতুল, মামলার সাক্ষী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা আসামিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এতে আসামিরা ভুক্তভোগী জান্নাতুলের ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পরে রাত ১০টার দিকে রিভা ও রাজিয়ার নির্দেশে আসামি আনিকাসহ অজ্ঞাতনামা ৩ থেকে ৪ জন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ভুক্তভোগীর রুমে প্রবেশ করেন। তবে, তাকে রুমে না পেয়ে তার ব্যবহারিক আসবাবপত্র ভাঙচুর করে নগদ ২০ হাজার টাকা ও ব্যবহৃত ল্যাপটপ নিয়ে যান।
এ সময় ভুক্তভোগী রুমে আসার পথে তাকে ঘিরে ফেলেন আসামিরা। তাকে বিভিন্ন ভাষায় গালিগালাজ করেন। একপর্যায়ে আসামিরা ভুক্তভোগী জান্নাতুলকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি ও মাথি মেরে বিভিন্নস্থানে জখম করেন। মামলায় রিভা ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে যা বলা হয় মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। তারা কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করতে থাকায় কলেজ ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রীদের লেখাপড়ায় চরমভাবে ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। ১নং আসামি তামান্না জেসমিন রিভা ও ২নং আসামি রাজিয়া সুলতানার নেতৃত্বে অন্য আসামিগণ ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য, অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসতে ছিলেন। বাদী জান্নাতুল ফেরদৌসী, সাক্ষীগণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীগণ আসামিদের এরূপ কর্মকাণ্ডে প্রতিবাদ করায় আসামিগণ বাদীর ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে থাকেন। বাদীনির ফুসফুসে ইনফেকশন ও পিত্তথলিতে টিউমার থাকায় গত ১৩ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে ভর্তি হন। অতঃপর ১ ও ২নং আসামি বাদীনির ফেসবুক মেসেঞ্জারে বিভিন্ন ধরনের জীবননাশের হুমকি প্রদান করায় সাংবাদিকগণ তা জানতে পারে।
সাংবাদিকগণ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাদীনির কাছ থেকে ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রলীগের কমিটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তার সাক্ষাৎ নিয়ে সংবাদ প্রচার করে। অতঃপর বাদীনিকে গত ২২শে আগস্ট হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলে ক্যাম্পাসে ফিরে হলে অবস্থান করতে থাকেন। বাদীনির ক্যাম্পাসে ফেরার সংবাদ আসামিগণ জানতে পেরে গত ২৪শে আগস্ট রাত অনুমান ১০টায় ১ ও ২নং আসামির নির্দেশে ৭নং আসামি আনিকা তাবাসুম স্বর্ণাসহ অজ্ঞাত ৩/৪ জন দেশীয় অস্ত্রসহ বাদীনির রুমে প্রবেশ করে বাদীনিকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে বাদীনিকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। বাদীনি ওই সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান করায় আসামিগণ বাদীনিকে না পেয়ে বাদীনির ব্যবহারিক আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। ওয়্যারড্রপে থাকা বাদিনীর চিকিৎসার ২০ হাজার টাকা ও বাদীনির ব্যবহৃত ল্যাপটপ ৭নং আসামি অজ্ঞাতনামা আসামিদের সহায়তায় নিয়ে যায়। ওই সময় ৭নং সাক্ষীসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী উক্ত হলরুমে থাকায় তাদেরকে জীবননাশের হুমকি দেয়।
অতঃপর বাদীনির বোন ২নং সাক্ষী ও ৩নং সাক্ষী বাদীনির রুমে আসার পথে আয়শা হলের সামনে পুকুরপাড়ে ১-৮নং আসামিগণ বাদীনি ও ২-৩নং সাক্ষীকে চারদিক থেকে ঘিরে ২নং আসামি বাদীনিকে বিভিন্ন ভাষায় গালিগালাজ করে। একপর্যায়ে আসামিগণ বাদীনিকে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি ও লাথি মেরে বাদীনির শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম করে। সাক্ষীরা বাধা দিলে তাদেরকেও এলোপাতাড়ি কিলঘুষি মেরে রক্তাক্ত জখম করে। ১নং আসামির হাতে থাকা হকিস্টিক দিয়ে বাদীনিকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় সজোরে বাড়ি মারে। বাদীনি সরে গেলে বাদীনির ডান হাতের কনুই রক্তাক্ত ফুলা জখম হয়। ২ ও ৪নং আসামি বাদীনির গায়ের উড়না খুলে নিয়ে বাদীনিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে দুদিক থেকে টান দেয়।
এরপর বাদীনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মৃত ভেবে আসামিগণ বাদীনিকে ছেড়ে দেয়। তখন ২-৩নং সাক্ষী চিৎকার দিলে অন্য সাক্ষীগণ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছালে ৩নং আসামি বাদীনির হাতে থাকা মোবাইল ফোন, ৫নং আসামি বাদীনির গলায় থাকা আট আনা স্বর্ণের চেইন এবং ৬নং আসামি ২নং সাক্ষীর হাতে থাকা মোবাইল ফোন এবং ৭নং আসামি ৩নং সাক্ষীর হাতে থাকা পার্স (যার ভেতর ৪ আনা ওজনের স্বর্ণের আংটি, ৫/৭ হাজার নগদ টাকা ছিল) চুরি করে নিয়ে যায়। অতঃপর বাদীনিকে আসামিগণ চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে ২নং গেটের গেস্ট রুমের পাশে নিয়ে পুনরায় শারীরিক নির্যাতন করে। এমতাবস্থায় বিভিন্ন হলের দায়িত্ব প্রাপ্ত ম্যাডামগণ বাদীনির ওপর নির্যাতনের সংবাদ জানতে পেরে ঘটনাস্থলে এসে বাদীনিকে আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে কলেজ ক্যাফেটোরিয়ার সামনে নিয়ে যায়।
তখন আসামিগণ বাদীনিকে ক্যাম্পাস না ছাড়লে জীবনে শেষ করে দিবে মর্মে হুমকি দেয়। বাদীনি পূর্বে শারীরিক অসুস্থ থাকায় এবং আসামিদের নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হলে রিতা ম্যাডামের বাসায় প্রাথমিক চিকিৎসা করানো হয়। তৎক্ষণাৎ অনেক ছাত্রী ঘটনাস্থলে সমাবেত হলে ৪নং সাক্ষী দোয়েলকে বাদীনির পক্ষের লোক জানতে পেরে ৩ ও ৬নং আসামি ৪নং সাক্ষীকে বেআইনিভাবে ক্যাফেটোরিয়ার সামনে থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে রাত ২ ঘটিকায় খোদেজা হলে ২০৫ নং রুমে আটকিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে আটক করে রাখে। পরবর্তীতে উক্ত হলের মোস্তারিম ম্যাডাম তাকে বিকাল অনুমান ৪ ঘটিকার সময় উদ্ধার করে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।